হাসিনার ছকে নির্বাচনে মার্কিনীদের না!

।।রেজা হাশমী।।
আজ আওয়ামী সরকারের সাথে মার্কিন প্রশাসনের সম্পর্কের যে ছেদ পড়ল, সেটা পূরণ হবার আর কোন সম্ভাবনা নেই। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ডেপুটি স্পোকসম্যান রবার্ট পালাডিনো তাঁর প্রেস বক্তব্যে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের ভিসা না দেওয়ায় যে ভাষায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। কেবল বৈরী দেশ বা সরকারদের সম্পর্কে তারা এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করে থাকে।
হাসিনা সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দূরত্ব তৈরি আরম্ভ হয় ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরপরই। ঐ নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল খুব শীঘ্র আরেকটা নির্বাচন করার। সেই প্রতিশ্রুতি তারা দ্রুতই ভঙ্গ করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন বারে বারে তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও হাসিনা সরকার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গে অটল থাকে। শুধু তাই নয়, আওয়ামী মন্ত্রীরা উচ্চপদস্থ মার্কিন কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রকাশ্যেই অসৌজন্যমূলক উক্তি করেন। এক পর্যায়ে হাসিনা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাত দেওয়া বন্ধ করে দেন, যাতে করে নতুন নির্বাচনের তাগাদা শুনতে না হয়। এমনকি, সফররত মার্কিন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ওয়েনডি শেরম্যানকে সাক্ষাতের সময় দিয়েও হাসিনা বৈঠক শেষ মুহূর্তে বাতিল করে দেন। এই ক্রমশীতল সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে যায় যখন গত অগাস্ট মাসে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মারশা বার্নিকাটের গাড়িতে হামলা হয়। হাসিনা সরকার ঘটনার তদন্ত ও ব্যাবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিলেও এ বিষয়ে কিছুই করা হয় নি। কোন মার্কিন প্রতিনিধির উপর এ ধরনের হামলা আগে আর কখনো বাংলাদেশে হয় নি। এটা ছিল “রেড লাইন” ক্রস করার মত একটি গুরুতর বিষয়। মার্কিন মহলে এতে ধারনা জন্মায় যে হাসিনা সরকার ক্রমশ একটি “বদমাশ সরকার” (রৌগ রেজিমে) পরিণত হয়ে যাচ্ছে।
আসন্ন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রই সব চাইতে বেশি আগ্রহ দেখিয়ে আসছে। নভেম্বরের শেষে তারা জানায় যে, তারা বারোটি পর্যবেক্ষণ টিম পাঠাবে এবং বিশ হাজার স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছে। হাসিনা সরকার ডিসেম্বরের তিরিশ তারিখ নির্বাচনের দিন নির্দিষ্ট করেছিল এই ভেবে যে ক্রিসমাস ও ইংরেজি নববর্ষের মাঝখানে এই তারিখ পড়ায় বিদেশী পর্যবেক্ষকরা আসবেন না। কিন্তু মার্কিন এই ঘোষণায় তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তার উপর মার্কিন কংগ্রেসে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট উভয় দল বাংলাদেশের নির্বাচন সম্পর্কে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত রেজুলেশন হাসিনা সরকারের জন্য একটি অশনি সংকেত হিসেবে আবির্ভূত হয়। কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত মার্কিন সরকারের জন্য পালনীয়। এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে কোন প্রকার ছাড় দেবে না।
পর্যবেক্ষকদের ভিসা না দেওয়ার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে হাসিনা সরকার জানান দিয়েছে যে মার্কিন সরকার বা কংগ্রেস যাই বলুক না কেন, তারা তাদের ছক অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে। অন্যদিকে, আজকের প্রেস বক্তব্যে মার্কিন সরকার নির্বাচনের বিষয়ে হাসিনা সরকারকে চারটি শর্ত বেঁধে দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে হাসিনা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবেঃ
(১) শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ ও মত প্রকাশের সুযোগ দান;
(২) নির্বাচন সম্পর্কিত সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনভাবে কাজ করার পথ উন্মুক্ত করতে হবে;
(৩) নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকের নির্বিঘ্নে তথ্য আদান-প্রদানের সুযোগ নিশ্চিত করা;
(৪) প্রত্যেক ব্যক্তির নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হবার ক্ষেত্রে কোন ধরনের হয়রানি, ভীতি ও সন্ত্রাসের শিকার হতে না হয় তা নিশ্চিত করা।
এবং এসব বিষয় আ’লীগ সরকারকেই নিশ্চিত হরতে হবে।
এ যাবত হাসিনা সরকার এর একটি শর্তও পূরণ করে নি, বরং ঠিক উল্টোটা করছে। নির্বাচনের আগে এগুলো পূরণের কোন আগ্রহ, উদ্যোগ বা সম্ভাবনাই দৃশ্যমান নয়। ফলে নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে হাসিনা সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এক অনিবার্য সংঘর্ষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেলো।
*লেখক যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বাংলাদেশী অধ্যাপক